রাজা-রানী খান খান! (তাতেই কী হয় অবসান?)…

 রাজা-রানী খান খান! (তাতেই কী হয় অবসান?)…


রাজা-রানী খান খান! (তাতেই কী হয় অবসান?)…

Posted on 23rd August, 2024 (GMT 16:40 hrs)

আখর বন্দ্যোপাধ্যায়

Abstract

The article is a satirical and allegorical narrative that criticizes authoritarianism and the suppression of dissent. It tells the story of a queen who, frustrated by her subjects’ silence, administers a pill that makes everyone scream against authority. This leads to chaos, with the queen’s attempts to suppress or escape the situation backfiring. The story reflects on the futility of authoritarian control, the inevitability of resistance, and the dangers of unchecked power structures.

একটু ধৈর্য ধরে পড়বার অনুরোধটুকু রইলো। আশা করছি যে আপনাদের খুব খারাপ লাগবে না। ভীষণ ক্রোধ আর আক্রোশ নিয়ে লেখা। ভুল-ত্রুটি মার্জনা করবেন। এ লেখা হলো অনেকগুলো সাম্প্রতিক “সত্য” (অ)ঘটনা অবলম্বনে কল্পনার অবাধ ছুটোছুটির কিত্তিকলাপ!

ওপরের ছবি “The Throne” এঁকেছেন শিল্পী রাজীব চৌধুরী।

১।।
রানী সম্ভাষণ করিলেন: “হে সভাসদগণ, কী তব বার্তা আজিকার? সব চাঙ্গা সি তো? কোথাও কোনো গোলমাল নেই, তাই তো?”
কিছু লোক উঠে দাঁড়িয়েও কী বলবে ভেবে পেলে না, আবার কিছু লোক বসে বসেই আপনমনে বিড়বিড় করতে লাগল। রানী এতে গেলেন বেজায় চটে। গলা খাঁকড়িয়ে বলিলেন: “ইয়ার্কি পেয়েছো নাকি? ভেবেছোটা কি? এমনি এমনি পার পেয়ে যাবে? সেটি হওয়ার নয়। আমার সমস্ত কথার জবাবে একটা “হ্যাঁ” বলতে তোমাদের বাধছে কোথায়?”
এর উত্তরে সবাই নির্বাক। কারোর যেন কিছুমাত্র বলবার নেই। অথবা, বলবার হয়তো আছে অনেককিছুই—কিন্তু কেউ ঠিক সাহস করে উঠতে পারচে না। দমের অভাব বোধ করছে। তারা বুঝছে যে তাদের চাদ্দিকটা প্রবলভাবে বিষিয়ে উঠেছে পুতিগন্ধময় ধুলো-ধোঁয়া-গ্যাসের দাপটে। কিন্তু “না” বলবার স্পর্ধা কিভাবেই বা দানা বাঁধতে পারবে? অনেক কাল আগে কোনো এক মেঠো উদয়ন মাস্টার এসব “না” বলা শেখাতো-টেখাতো—কিন্তু তারা তো আজ কতদিন হলো তামাদি হয়ে গেছে। শোনা গেসলো তাঁকে নাকি দূরে কোন এক মরুভূমিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। যেখানে পারমাণবিক টেস্ট হয়। যাক সে কথা। মুদ্দায় ফিরি।
এমন নিশ্চুপ রকম-সকম দেখে তলব করা হলো সম্মানীয় বোবার গবেষককে। পরীক্ষা করা হলো সকলে সত্যিই কথা বলতে পারে না কিনা, নাকি পুরোটাই একটা বিরাট ভাঁওতাবাজি। কই না তো! সত্যিই দেখা গেলো যে সে রাজ্যের প্রায় সক্কলকেই একটা সাময়িক ব্যাধি এসে চুপ করিয়ে দিয়েছে। এ ব্যাধি কোত্থেকে এলো, তা শতবার মাথা চুলকেও সে গবেষক বলতে পারলে না। (নাকি, বলতে চাইলো না?)
কী করা যায়? রানী ভাবিতে শুরু করিলেন। কিন্তু কোনো উপায় ভাবিয়া পাইলেন না।
হঠাৎ একদিন বোবার গবেষক হন্তদন্ত হয়ে এসে বললেন: “একখান অ-দেশীয় বড়ি আছে বটে, যাতে এ রোগ সেরে যায়। তবে সেটা খাওয়ালে সকলেই অনবরত যেকোনো চরম কতৃপক্ষের বিরুদ্ধে চিৎকার করতে থাকে। সেটা কী আপনি চাইবেন ম্যাডাম?”
রানী শেষ কথাটা শুনে প্রথমটায় খানিক ঘাবড়ে গেলেও একটু সামলে নিয়ে চাপা গলায় বলিলেন: “আচ্ছা! তাই সই। এই অন্তর্ভেদী নীরবতা আর যে নেওয়া যাচ্চে না। প্রতিবেশী রাজ্যরা তো যাতা ছিঃ-চিৎকার করছে। বলছে যে ও দেশের রানী নাকি কাউক্কে কথা বলতে দেয়না, একমাত্তর নিজেই বকবক করে যায় আর তাই সবাইকে মুখ বুজে শুনতে হয়। সেজন্যই বলছি— চিৎকারই সই! তা সে আমার বিরুদ্ধে হলোই বা! এট্টু সহ্য করে নেওয়া যাবে খন। ওটা তো সাইড এফেক্ট মাত্র— কতদিনই বা টিঁকবে? কতদিনই বা চলবে? দু’দিন বাদে সব থিতিয়ে গিয়ে নেশা কেটে স্বাভাবিক স্বর-প্রতিস্বরের কথোপোকথন চালু হবে আবার। আমিও নাহয় তদ্দিন তাদের সঙ্গে রাস্তায় নিজের সাঙ্গ-পাঙ্গ নিয়ে পোতিবাদ করে নেবো। ও আমি আগেও ঢের তৈরি করেছি। এখন তুমি এ বড়ি জলদি আনানোর ব্যবস্থা করো দিকি।”
যেমন হুকুম, তেমন কাজ। জনে জনে বড়ি দেওয়াও হলো বলে শোনা গেলো। যদিও সেটা নাকি করা হলো এক গোপন বিকিরণকারী যন্তরের সাহায্যে, সকলের এক্কেরে অজান্তে। এই বয়ানের লেখকও ঠিক এখনো অব্দি জানেন না যে কিভাবে এর প্রয়োগ ঘটে গেলো—হঠাৎ করেই। কিন্তু হলো। আটকানো গেলো না। হতেই হলো। রানী যা ব্যস্তসমস্ত হয়ে গেসলেন!
তারপর কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেলো সব। সকলে এমন চিৎকার করতে লাগলো যে বন ছেড়ে পশু-পাখির দল পাততাড়ি গুটিয়ে দৌড় দিলো। অনেকে আপত্তি জানিয়ে বললো, ওরা ঠিক পালাতে চায় না। পাখিরা নাকি উড়ে গিয়ে দক্ষিণের প্রদেশ থেকে তাদের আরো সাথীদের জোগাড় করে আনতে গেছে। সবাই এলেই নাকি এক জায়গায় চিৎকার করা হবে। ওদিকে গাছেরা তো কাঁদতেও পারলে না, নিজের শোক বা ক্রোধ জানাবার উপায়ও পেলে না। তবে তারাও পারে। ঢের ঢের কথা বলেও চলে। তাদের তো বলবার থাকেই। কিন্তু সেসব পারলেই বা কী? কোন মানুষই বা তা খেয়াল করবে? খেয়াল রাখবে? সবাই যে নিজেদের শোরগোল নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। রানীর যাবতীয় (সু)রক্ষাকবচ আর কাজ করলে না, কিছুতেই ঠেকাতে পারলে না এ লহরকে।
রাজ্য ধসে পড়বার জোগাড়। সবাই সবার ওপর চিৎকার করে। তবে সবচেয়ে বেশী জোরের সঙ্গে চিৎকার করে রানীর বিরুদ্ধে, সংগঠিত হয়ে। তারা এক স্বরে বলেঃ রানী মহা ধূর্ত, সে নাকি স্রেফ রাজকোষের লোভ দেখিয়ে মন্ত্রী ও পারিষদবর্গের লোকেদের হাত করে রেখেছে। অনেক জনগণকেও এদ্দিন ভুলিয়ে রেখেছিলো নিত্যিনতুন উৎসবের আড়ম্বরে। আজ রানীর প্রয়াত পিতার জন্মদিন (একসময়ের দুর্ধর্ষ দুশমন বলে তাঁকে অনেকেই) তো কাল নাকি রানীর এককালের সেনাপতির শহীদ দিবস। প্রজার ব্যাপক টাকা উড়িয়ে এসব জাঁকজমকের মোচ্ছব থামবার নামও নেয়না যেন কোনোমতেই। তার উপর সবচে বড়ো কথা হলো রানী নিজে মেয়ে হয়েও তার গোটা সাম্রাজ্যের মেয়েদের বাঁদি বানিয়ে দমিয়ে রাখতে চায়, কথা বলতে দিতেই চায়না তাদের প্রতিদিনের সমস্যাগুলোকে নিয়ে। রানী খালি বলেনঃ “ও সব তো হতেই থাকে। ওসব ছোট্ট ঘটনা। ওরম একটু-আধটু হতেই পারে। এসব তোমাদের দোষ। এতো খোলাখুলি লাফালাফি না করলেই কী নয়? এই নাও কিছু টাকা।“
বড়ি-প্রয়োগের পরে এই টাকা দিতে এলেই অনেক মেয়েরাই একসাথে গর্জে উঠে সরাসরি বললেঃ “এটা তো আমাদেরই টাকা! সে টাকা ঘুরিয়ে আমাদেরই দিয়ে মুখ বন্ধ করিয়ে রাখতে চাইছেন?! এমন করছেন যেন এ সম্পত্তি আপনার নিজের পরিবারের? সাহস তো কম না! আমাদের কী বাজারে বিক্কিরি হওয়ার অকেজো জিনিসপত্র ভাবেন?”
এবার হলো কী জানেন? একদিন এইসব ভীষণ চিৎকারের মাঝেই, রাজপ্রাসাদের খুব কাছের এক অঞ্চলেই একটি মেয়েকে বিশ্রীভাবে দলে-পিষে-ছিঁড়ে মাটিতে মিশিয়ে দিলো রানীর পোষা কিছু দামড়া ছেলে সেনার দল। তারপর খুব তাড়াহুড়ো করে সে মেয়েটির জামাকাপড়ে কেরোসিন ঢেলে দিয়ে ধরিয়ে দেওয়া হলো আগুন! এই কান্ড ঘটিয়ে সেই ছেলের দল রানীর বিশেষ সার্টিফায়েড যানে চেপে চম্পট দিলো চোখের নিমেষেই!
অনেকেই দেখলেন। অনেকেই দেখেও ঠিক খেয়াল করলেন না। সবাই হতভম্ভ হয়ে সে নির্মম দৃশ্য সাক্ষাত করবার পরেই চিৎকারের তীব্রতা গেলো বহুগুণে বেড়ে! আসলে ব্যাপারটা হলোঃ মেয়েটা নাকি রানীর হাঁড়ির খবর, অর্থাৎ তার যাবতীয় প্রজা-প্রতারণার খবর আগে থাকতেই জেনে গিয়েছিলো। সে যদি এ বড়ির প্রভাবে এ সমস্ত বলতে শুরু করতো, তাহলে তো…
তার বিপক্ষে এত্তো প্রতিবাদমুখরতায় রানীর তো প্রায় কালা হওয়ার জোগাড়। এতোটা তিনি তো দুঃস্বপ্নেও আশা করেন নি। তার তো প্রায় উন্মাদ হওয়ার মতোন অবস্থা। তখন তিনি ঠিক করলেন যে একটা উড়ন্ত চাকলি নির্মাণ করে সেখান থেকে উড়ে পালিয়ে এক ঘনিষ্ঠ “রাজর্ষি”র রাজ্যে গিয়ে ক’দিনের জন্য আশ্রয় নেবেন এবং এই অবস্থার হাল যৌথভাবে বের করবেন। সেই রাজাও যদিও এই রানীর মতোনই স্বভাব-চরিত্তিরের। তবুও তার পয়সায় পোষিত গুণগান গাওয়ার লোকেরও অভাব নেই। আসলে এই রাজার পরামর্শদাতা হলো দুজন অতিধনী ও প্রভাবশালী বৈশ্য। এই বৈশ্য দুজনের কাজই হলো লোক ঠকিয়ে মুনাফা তোলা। তাদের পরিবারের হাতেই রাষ্ট্রের যাবতীয় ক্ষমতা। রাজা তো লোকদেখানো আনপড় পুতুলমাত্র।

শিগগিরি যোগাযোগ করা হলো সেই রাজার সঙ্গে। তিনি সবটা শুনিয়া বলিলেনঃ “আমি তো এব্যাপারে কিছু সাহায্য করতে পারবো না। হ্যাঁ, এই চিৎকার রোগের দাওয়াই আমার বিশেষ কবিরাজের কাছে আছে বটে, তবে সেটা আমি এমনি এমনি তো দেবো না বাওয়া। তোমার রাজত্বের দখল নেবো, তবেই মানবো। নইলে এতে আমার কিই বা লাভ শুনি?”
রানী হতাশ হয়ে পড়লেন। ক’দিন বাদে সত্যি সত্যিই সেই পড়শি রাজার দলবল এসে রানীকে যা নয় তাই বলতে থাকলো অন্যান্য চিৎকারকারীদের সঙ্গে মিলে-মিশে গিয়ে, রাস্তার মাঝে মঞ্চ বানিয়ে-টানিয়ে। এসব কান্ডে রানীর রাজ্যের আসলি প্রতিরোধী জনগণ বেজায় চটে গিয়ে সেই রাজার প্রবল প্রতাপকেও রোখবার জন্য পরপর ধর্ণায় ও ধর্মঘটে বসলো। এখন রানী আর রাজা, কাউকেই কেউ আর ছেড়ে কথা বললো না।
রাস্তা-ঘাট-জনপদ ভরে গেলো মানুষে মানুষে। শুধু মাথা আর ছাতা। ঝড়-জল-বাদলাকে উপেক্ষা করে, ব্যক্তিগত খর্বতা ভুলে গিয়ে সব স্বৈরশাসকদের সিংহাসন ধ্বংসের ডাক এলো। দখল হলো দিন থেকে রাত। ডাক দেওয়া হলো রাজা ও রানীর শাসন থেকে মুক্তি ঘটানোর— এক নতুন সময়ের।
[আসলে কী বলুনতো? বড়ি-টড়ি ওসব কিস্যু নয়। বোবার গবেষক আদতে এক নির্বাসিত আন্ডারগ্রাউন্ড দলের বহুদিনকার সদস্য। সে গুপ্তচর হিসেবে রানীর দলে গিয়ে যোগ দিয়েছিলো। বড়ি দেওয়ার নাম করে সে আদতে রানীর সমস্ত কিত্তিকলাপ লোকজনকে গিয়ে গিয়ে জানিয়ে এসেছিলো তাঁর বিশ্বস্ত কিছু সহযোদ্ধার সাহায্যে। তাতেই এই অবস্থা। রানীকে অবশ্য সেসব একটুও জানতে দেওয়া হয়নি!]

ঘরে ঘরে ডাক পাঠাই, জোট বাঁধো, তৈরি হও…

২।।
২১ বছরের প্রীতি লোড করে ফেললো তার বন্দুক। সে দেখলো, তার হাত একটুও কাঁপছে না। দৃপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে গেলো বিস্মৃতির উন্মত্ততার ক্লাবটার দিকে।

অন্যদিকে—-

“আমরা শহরের এবং তার আশপাশের সমস্ত টেলিফোন পোস্ট, বেতার কেন্দ্রগুলো দখল করে ফেলেছি। এবার কি করার?”
মাস্টারদা হুকুম দিলেনঃ “বাকি দেশ না হোক, আজ রাতে এই অঞ্চলটাকে স্বাধীন করেই ছাড়বো। সমস্ত যোগাযোগ মাধ্যম ছিন্ন করে দাও। ওরা যেন কিছুতেই খবর পাঠাতে না পারে।“
হলোও তাই। সেদিন রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসীদের হাতে ঝাঁঝরা হলেন অনেকেই। তবে রক্তের অপচয় হলো না। অপচয় হলো না চিত্তের, যে চিত্তের দৈন্যে আমরা এতকাল ধরে ভুগছি। “শিক্ষা”টা রয়ে গেলো। এই “শিক্ষা” দেওয়ার আবার দুটো মানে, জানেন তো? এক হলো পড়াশোনা, জ্ঞান-গম্যি-বোধ অর্জন ইত্যাদি। আরেকটা হলো সাজা দেওয়া। সেই সাজা দেওয়া মানে কেবল ফাঁসিতে ঝোলানো নয়, তা বরং একরাশ নির্ভয়ের, অভয়ের মার খেয়েও মরে না যাওয়া স্বপ্নগুলোর প্রজ্বলিত দীপ। এক নিভন্ত তিলোত্তমার ফের ফোঁস করে জ্বলে ওঠবার আগুন— আর সেই আগুনের যাবতীয় রেশ ও রেষারেষি!
সব পুড়ছে। আমি পুড়ছি। ব্রহ্মাণ্ড পুড়ছে।

৩।। “অনেক কথা যাও যে বলে…”
হ্যাঁ। সেই বনের পাখিগুলো নিজের রাজ্যে ফিরেছিলো কিছুদিনের মধ্যেই। (অবশ্য পাখিদের আর নিজের-পরের কি? পুরো পৃথিবীটাই তাদের অবাধ বিচরণক্ষেত্র– পাসপোর্ট ছাড়াই!) সাথে অনেক পাখি নিয়ে এসেছিলোঃ তাতে ছিলো ডোডোর দল, হোমাপাখির দল, ত্রাসনমুক্ত খাঁচাভাঙা তোতাদের দল — আরো কতো কি! তাদের উড়ন্ত অবস্থানে পুরো আকাশ গেছিলো ঢেকে। আন্দোলিত আরামে আচ্ছন্ন হয়েছিল ধরিত্রী। তবে পাখিদের সঙ্গে প্রধাণ অতিথি হিসেবে এসেছিলো একটা খোঁড়া হাতি। তার একটা পা কারা যেন শলাকা জাতীয় কিছু একটা দিয়ে বেশ কিছুটা চিরে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিয়েছে। তার পিঠ দিয়েও রক্ত গড়িয়ে পড়ছে মাটির ওপর। তবুও সে হাঁটছে, আর ডাক দিচ্ছে শুঁড়টাকে শূন্যে দুলিয়ে দিয়ে। হাতিটার পিঠে ওটা কি? একটা রক্তাক্ত হাতির বাচ্চার ভ্রূণ– সেটাও যে নড়ছে! একটা স্পন্দন টের পাওয়া যাচ্ছে! গাছেরা এসব দেখে বেজায় খুশী। তারাও নেচে-গেয়ে ওঠে মেয়ে হাতির সে দামামাসম হুংকারে। রানী-রাজা সব্বাই ততক্ষণে পগারপার। বাজারে খবরঃ তারা নাকি রকেট চেপে একটা মহাশূন্যে ভাসমান ঘাঁটিতে গিয়ে কোনোমতে বসবাস করবে ঠিক করেছে।

এদিকে মানুষ-না-মানুষের সঙ্গবদ্ধ আওয়াজের সে যৌথতার সমভূমি রাজপ্রাসাদের স্থুল নির্মাণের “ওপাশ”-টা কিংবা “ওপার”-টা খুঁজতে অগ্রসর হয়। গিয়ে দেখা যায় যে এক প্রবল বন্যা এসে গ্রাস করছে জঙ্গলের পর জঙ্গল — ঘাসজমির পর ঘাসজমি — জনপদের পর জনপদ। জল কেবলই বেড়ে চলেছে… একটু বাদে দাঁড়াবার জায়গাটুকুও আর থাকবে না! তার মধ্যেই শুরু হলো ভয়ানক ঝড়ের দাপট…

আর বসে থাকা চলেনা। কালটা এখন, আর “কাল” নয়।

কলকাতা, ২৩-০৮-২০২৪


নিচে যে লেখাটি দেওয়া হচ্ছে, সেটি গপ্পো নয়। ওপরেরটাও নয়। ফ্যাক্ট আর ফিকশনের কৃত্রিম ভাগাভাগিটা ধসে যায় বারবার, জবানি ও অ-জবানির নিরন্তর ঘাত-প্রতিঘাতে। তাই রইলো একটা বক্তব্য। বিষয়ঃ “জাস্টিস=ফাঁসি?”। প্রেক্ষাপটঃ আর-জি-কর ধর্ষণ ও খুনের পরবর্তী অবস্থা ও আজকের রাস্তা-ঘাট।

তালপাতার সেপাই সম্প্রতি গান বেঁধেছেন, যার প্রথম লাইনঃ “অহেতুক আজ কথা না বাড়ানো ভালো…”

সত্যিই তাই, অনেক কথা বলা হচ্ছে।

কেউ বলছে এটা ঠিক, তো কেউ বলছে ওটা। আদতে যে কোনটা মেনে নেওয়া যেতে পারে, সেটাই বোঝা দায়।

সবাই বলছেন: we want justice. আমিও বলেছি। আগামীদিনেও বলবো। কিন্তু জাস্টিস বলতে কি বুঝছি ঠিক?

তাই চটপট কয়েকটা জরুরি কথা বলে নেওয়া দরকার।

বিচার। শাস্তি। ফাঁসি। ন্যায়। নীতি।

শব্দগুলো কি আদৌ সমার্থক বা সিনোনিমাস? 

ধর্ষণের মতোন ঘটনা নি:সন্দেহেই মেজর ক্রাইমের তালিকার মধ্যে পড়ে।

কিন্তু তার থেকে বেরোনোর উপায় কি সেই ধর্ষকদের খুঁজে বের করে ফাঁসিতে ঝোলানো? 

অনেকে আবার বলছেন ফাঁসি দিলে তো এক মুহুর্তেই মৃত্যু ঘটবে। বরং দরকার এসব অত্যাচারীদের তিলে তিলে মারা, যে নৃশংসতা এরা তিলোত্তমাদের ওপর দেখিয়েছে, ঠিক সেভাবেই এরাও যেন সমান কষ্ট ও যন্ত্রনা পেয়ে মরে। একে বলা যেতে পারে: eye for an eye, tooth for a tooth নীতি —এক্সোডাসের বই মেনে। এখানে শাস্তি আয়নায় প্রতিফলিত করবে ক্রাইমের ইন্টেনসিটি বা তীব্রতা ও সিভিয়ারিটিকে।

এতে করে হবেটা কি? অনেকে যুক্তি দিতে পারেন যে এভাবে এরপর থেকে আর কারোর এরকম ভয়ানক ঘটনা ঘটানোর সাহসটি পর্যন্ত হবেনা। তারা ভয় পাবে। তারা deterred হবে। 

কিন্তু এখানে বিচারের মানেটা কেমন জানি গুলিয়ে যায়। যে  tit-for-tat retribution খোঁজা হচ্ছে এক প্রতিহিংসক বয়ানে, সেটাকি এখানে আদৌ মিলছে, মিললেও ঠিক কিভাবে? টেররিস্টদের ফাঁসি দিলেই কি আর টেররিজম ঘটেনা? ফাঁসি দিলে কি টেরোরিস্ট মানসিকতা বিলুপ্ত হয়? তেমনি, রেপ মানসিকতা বা রেপ সংস্কৃতি কি এভাবে শেষ করা যাবে? এর গ্যারেন্টি কি? এবং দায়িত্ব কে নেবে? ভয় দেখিয়ে নৈতিকতার প্রতিষ্ঠা করতে যাওয়া, যেটা মূলত অর্গানাইজড ধর্মগুলো করে থাকে, সেটাতে নৈতিকতার মূল মন্ত্রই আঘাতপ্রাপ্ত হয়। এক বর্বরোচিত আগ্রাসনকে রুখতে গিয়ে আরেকটি রাষ্ট্র-পোষিত আগ্রাসনকে লেজিটিমাইজ করে দেওয়া হয়। কাম্যু একে বলেছেন জুডিশিয়াল মার্ডার।

অনেকে এটা শুনে বলবেন: তা হোক। ওসব তো সুদূর ভবিষ্যতের কথা। এখনকার মতো ফাঁসিই একমাত্র জনগণের নার্ভ শান্ত করতে পারবে। 

মানলাম। আজ যে প্রবল ক্ষোভ এবং প্রতিরোধ উগড়ে দেওয়া হচ্ছে রাস্তায় রাস্তায়, যার একটা অংশ আমি নিজে— সেখানে এই আবেগী outburst খুব স্বাভাবিক এবং ন্যায়সঙ্গত. যে সমাজ ক্ষতের ত্বকের ট্রমা এখন এই সময়টা বয়ে নিয়ে চলেছে তাতে এটাই হচ্ছেই, হবেই, হবেও। কিন্তু এর ফলে এটা ভুলে গেলে চলবেনা যে লড়াইটা আরো অনেকটাই সুদুরপ্রসারি। এই সংকীর্ণ মানেতত্ত্বে বিচার শব্দটাকে বেঁধে ফেলা এর প্রতি তীব্র অবিচার হবে। লড়াইটা পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার রোজকার অপমানের, হিংসার, কটাক্ষের, ছোঁয়ার, অপরিকরণ বা আদারিং-এর বিরুদ্ধে। লড়াইটা প্রার্থিত সাম্যের, অধিকার দখলের তো বটেই। 

কিন্তু তার মানে তো এই নয়, যে বৈষম্যের ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে থাকা অযাচিত রাষ্ট্রযন্ত্রটাকে জীবন নিয়ে নেওয়ার ক্ষমতাটা আমরা দিয়ে দেবো যাতে সেই রাষ্ট্র একটা ডেমিগড হিসেবে নিজেকে প্রতিপন্ন করতে পারে? গান্ধী বলতেন, একমাত্র যে জীবন দেয়, সেই জীবন নিতে পারে।  কথাটা ধর্মীয় অর্থে উনি বলে থাকলেও, তার ইম্পলিকেশন সহজেই অনুধাবন করা যায়। গান্ধীর সন্তানেরা নাথুরাম ও আপ্টের ফাঁসির বিরুদ্ধে ক্যাম্পেইন চালিয়েছিলো বলেই আমরা জানি। এর থেকেও বড়ো কথা, জীবন মরণের ডিসিশন রাষ্ট্রের হয়ে নেবেটা কে? একটা ল ট্রাইবুনাল? একজন প্রধাণমন্ত্রী? একজন রাষ্ট্রপতি? তার দণ্ডবিজ্ঞানগত বা penological দৃষ্টিভঙ্গী সবটা ঠিক করে দেবে?

রেয়ারেস্ট অফ দ্য রেয়ার ঘটনা ফাঁসি ঘটানোর চেয়ে আরো ঢের বেশী প্রয়োজন একটা সামগ্রিক বৌদ্ধিক, নৈতিক ও সাংস্কৃতিক রেনেসাঁসের পরিকল্পনা নিয়ে এগোনো— যার মাধ্যমে বিষমকামী পুং-তান্ত্রিক normativity-র দ্বিত্বের বাইরে গিয়ে আমরা ভাবতে পারি, নিজেদের ‘আনলার্ন’ করিয়ে যথাসম্ভব সংশোধনের প্রয়াস চালাতে পারি by giving sincere efforts. প্রত্যেকের মধ্যে অন্তর্দর্শন বা introspection-এর আঘাতে নিজেদেরকেই নিজেরা systematic জোর করে বিবেকের ধাক্কা মেরে বাধ্য করতে পারি তথাকথিত সনাতন বোল-চাল-রীতি-নীতি পাল্টানোর দিকে এগিয়ে যেতে। আম্বেদকর বলেছিলেন না: there is nothing sanatan. এর জন্য সময় লাগবে ঠিকি, কিন্তু সেটাই হবে সত্যিকারের দৃষ্টান্তমূলক জাস্টিস। কেবল সংশোধনের নামে ফের ঘুরপথ দিয়ে পিতৃতান্ত্রিক শাসন-ত্রাসনকারী স্বাভাবিকিকরণ প্রক্রিয়া সবভাবে পরিত্যাজ্য হোক। তাতে আখেরে “সমাজের মূল স্রোত”-এর নামে পুং-প্রিভিলেজই শেষমেষ প্রতিষ্ঠিত হয়। কাজেই, চলতি অর্থে রিফর্মেশন এর অর্থকেও সমস্যায়িত করা প্রয়োজন।

তবে হ্যাঁ, এর মানে আবার এটা নয় যে আমি চাইনা এই ঘটনার দোষীরা চিহ্নিত না হয়ে আমাদের আশেপাশেই ঘুরে বেড়াক: বিলকিস বানোর ধর্ষক, আসিফার ধর্ষক, উন্নাওয়ের ধর্ষক, কুস্তিগীরদের molesterদের মতোন। কক্ষনো না। যে ঘৃণ্য অপরাধ তারা করেছে, তার জন্য ইতিহাস তাদের কখনোই ক্ষমা করবে না। আর ইতিহাস ঐক্যবদ্ধ মানুষই তৈরি করে।

এরা অবশ্যই ধরা পড়ুক। হয়তো এদের তারপর ফাঁসিতেও ঝোলানো হবে। কিন্তু ভবিষ্যতের কথা ভেবে জাস্টিসের বৃহৎ স্পেক্ট্রামের লড়াইটা ফাঁসির অস্থায়ী সমাধানে আটকে গেলে চলবে না কোনোমতেই।

লড়াই চলতে থাকুক।


Comments

Popular posts from this blog

None Kept One’s Words: Modiji’s Promises

How Do We Have So Little in Our Pockets Given That The Few Have So Much Money?

Incommensurability Amidst PMLA and IBC in the Context of the DHFL Scam